কুশল দাশগুপ্ত’ শিলিগুড়ি:
যুদ্ধ আবহে সোমবার রাত থেকে চিকেন নেক সহ উত্তর-পূর্ব ভারতজুড়ে ব্যাপক সেনা তৎপরতা শুরু হল। দিল্লির সতর্কবার্তা পেতেই নাশকতা রুখতে শুরু হয়েছে জয়েন্ট ইন্টারনাল সিকিউরিটি এক্সারসাইজ। মায়ানমার, চিন, বাংলাদেশ সীমান্তে সেনার সঙ্গে বিএসএফ (BSF) এবং র্যাফ সিকিউরিটি এক্সারসাইজে অংশ নিয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক এলাকায় একসঙ্গে নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করে শনিবার দিল্লি থেকে সেনা গোয়েন্দারা বিশেষ রিপোর্ট পাঠান। তার ভিত্তিতে ভারতীয় সেনার বিশেষ দল, আসাম রাইফেলস, সিআরপিএফ, বিএসএফ, আইটিবিপি এবং স্থানীয় পুলিশের যৌথ দল তৈরি করে জঙ্গিদমনে শুরু হয়েছে বিশেষ অপারেশন। ইতিমধ্যেই সেই অপারেশনে উদ্ধার হয়েছে প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র ও গোলাবারুদ। মায়ানমার সীমান্তে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একাধিক জঙ্গিঘাঁটি।
উত্তর-পূর্ব ভারতের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সেনা ও বিএসএফের গোয়েন্দারা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সোমবার কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে দীর্ঘ বৈঠক করেন ভারতীয় সেনার ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরসি তিওয়ারি এবং বিএসএফের ইস্টার্ন কমান্ডের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল মহেশকুমার আগরওয়াল। সেই বৈঠকের পর চিকেন নেকের নিরাপত্তায় সেনা ও বিএফএফের কাছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের নির্দেশ পৌঁছেছে। সোমবার রাত থেকেই কার্যত সিল করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ সীমান্ত। কাঁটাতারহীন সীমান্তে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েনও করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: আজকের দিনে মুক্তি পেয়েছিল ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’
উত্তরবঙ্গের সমস্ত শহরে বাড়তি নজরদারি শুরু করেছে সেনাবাহিনী। সূত্রের খবর, প্রাথমিকভাবে উত্তরবঙ্গের ‘স্পর্শকাতর’ চল্লিশটিরও বেশ জায়গায় সেনার বিশেষ অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেইসব ক্যাম্পে যুদ্ধাস্ত্র মজুত থাকবে। হঠাৎ হামলা হলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করবেন ক্যাম্পের জওয়ানরা।
যেসব এলাকায় বা শহরের পাশে সেনার নিজস্ব জমি আছে সেখানেই ক্যাম্প করা হবে। যেখানে সেনার জমি নেই সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের জমিতে ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের এনসিসি ইউনিটগুলিকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। এনসিসি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের একটি তালিকা ও ফোন নম্বর প্রস্তুত করতেও বলা হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের কাজে লাগানো হতে পারে বলে জানিয়েছেন এক সেনাকর্তা।
চিকেন নেকের নিরাপত্তায় বাড়তি শক্তি হিসাবে সক্রিয় করা হয়েছে ইস্টার্ন কমান্ডের ব্রহ্মাস্ত্র কর্পসকে। সোমবার থেকে রাঁচিতে শুরু হয়েছে এয়ার ল্যান্ডেড অপারেশনস। সি-১৭ গ্লোবমাস্টার বিমান অপারেশনে অংশ নিয়েছে। যুদ্ধ লাগলে বা হঠাৎ আক্রমণ হলে চিকেন নেক এলাকায় দ্রুত সেনা, রসদ, অস্ত্র, ওষুধ পৌঁছানো অথবা আক্রান্তদের নিরাপদ এলাকায় নিয়ে যাওয়ার কাজ কীভাবে হবে তার মহড়া হচ্ছে রাঁচিতে।
আসাম রাইফেলসের পক্ষে জানানো হয়েছে জঙ্গিদমনের বিশেষ অভিযানে ইতিমধ্যেই মায়ানমার সীমান্তের পার্বত্য এলাকায় পনেরোটিরও বেশি জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ১৭ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই ঘাঁটিগুলিতে চিন থেকে আনা প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র মজুত করা হয়েছিল। ঘাঁটিগুলি থেকে এখন পর্যন্ত ১৪টি ইম্প্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি), পঞ্চাশটিরও বেশি একে সিরিজের রাইফেল, প্রচুর চিনা হ্যান্ড গ্রেনেড, রকেট লঞ্চার, মর্টার শেল, ওয়্যারলেস সেট ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে।
নিরাপত্তার কারণে চিন থেকে মায়ানমার হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢোকা অস্ত্র সরাসরি চিকেন নেক এলাকায় আনতে পারছে না জঙ্গিরা। সেক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হতে পারে অস্ত্র। তারপর সীমান্তের নিরাপদ পাচার করিডর দিয়ে সেই অস্ত্র চিকেন নেক এলাকায় আনা হতে পারে। এমন পরিকল্পনা করছে দেশবিরোধী শক্তিগুলো। কেন্দ্রের গোয়েন্দা রিপোর্টে সেই আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। তাই উত্তরবঙ্গ ও অসমের বাংলাদেশ সীমান্তে ২৪ ঘণ্টা ড্রোনে নজরদারি শুরু করেছে বিএসএফ।
গতকাল থেকেই বা বলতে পারা যায় গতকাল হামলার পর থেকে শিলিগুড়ি বেশ কয়েকটি জায়গা জুড়ে চলছে কঠোর নিরাপত্তা। তার মধ্যে সবথেকে এগিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন। গতকাল সকাল থেকে প্রায় তিনগুণ পুলিশ , আর্মির ব্যাটেলিয়ান পৌঁছে যায় নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনে। নাশকতা এখান থেকেই ছড়াতে পারে , এই অনুমান করেই নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মোতায়ন করা হয়। কোন জায়গায় কোন সন্দেহজনক জিনিস দেখলেই সেখানে সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে স্নিফার ডগ। নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন এবং তার আশেপাশে সমস্ত এলাকাকে নিরাপত্তা চাদরে ভরিয়ে দিয়েছে পুলিশ এবং আধা ব্যাটেলিয়ান। গতকাল সন্ধ্যার পর থেকেই তা আরো তিনগণ বেড়ে যায়। নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন । তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থার যাতে কোন ত্রুটি না থাকে সেটা দেখতে গতকাল দুবেলা স্টেশন পরিদর্শন করেন নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর এবং সুপারভাইজার। কোনভাবে যাতে নাশকতা না করা যায়, এবং যাত্রী নিরাপত্তার জন্য সব রকম সুরক্ষা দিতে তারা নির্দেশ দেন। নিউ জলপাইগুড়ি রেলওয়ে স্টেশন সকাল থেকেই ছিল পুলিশি চাদরে মোড়ে দেওয়া।